রবিবার, ২৯ Jun ২০২৫, ১২:৪৭ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

মার্কিন নিষেধাজ্ঞা স্নায়ুযুদ্ধের নতুন রূপ

মনোয়ারুল হক:
ট্রাম্পের পথই অনুসরণ করছেন জো বাইডেন। বিশ^ রাজনীতিতে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকান উভয়ের রণকৌশল একই রকমের। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্র্তৃত্ববাদ তাদের লক্ষ্য। তাদের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারিত হয় সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে। ট্রাম্পের বিদায়ের পর ধারণা করা হচ্ছিল, নতুন বিশ^ পরিবেশ সৃষ্টি হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক পরিসরে বাইডেন ট্রাম্পের নীতি অনুসরণ করছেন। বিশে^র অন্যান্য অর্থনৈতিক শক্তির সঙ্গে পুরনো কায়দায় দ্বন্দ্বে লিপ্ত হচ্ছে। চায়না ও রাশিয়ার সঙ্গে পূর্বসূরি ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনুসৃত নীতি বাস্তবায়ন করছে। বাহ্যিকভাবে কিছুটা পার্থক্য বিশ^ রাজনীতিতে ঘটানোর চেষ্টা করেছে, কিন্তু তা খুব কার্যকর কিছু নয়। ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার দ্বন্দ্বে সরাসরি ইউক্রেনের পক্ষ নিয়েছে বাইডেন। মার্কিন অস্ত্র সেখানে যুদ্ধের প্রধান চালিকাশক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছিল, যা পরিশেষে আরেক দফা ইরাক-সিরিয়ার মতো ব্যর্থ হিসেবেই প্রমাণিত হলো।

বিশে^র ১০০ দেশ নিয়ে সাম্প্রতিক আলোচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘গণতান্ত্রিক সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়েছে। অংশগ্রহণকারী দেশগুলো মূলত বর্তমান মার্কিন বৈদেশিক নীতির সহযাত্রী ও সমর্থক। এই সম্মেলন থেকে বাংলাদেশকে দূরে রাখা হয়েছে। এর কারণ হতে পারে, সাম্প্রতিক বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক। ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু থেকে সরে এলে চীন সেই প্রকল্পে অর্থায়নের মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকারের সঙ্গে কার্যকর সখ্যতা অর্জন করে এবং তা অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সুখকর নয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘকাল যাবৎ ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকান উভয়ই পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চলত তাদের অস্ত্র বাণিজ্যের স্বার্থে। এই ধারা থেকে ডোনান্ড ট্রাম্প বেরিয়ে এসে ভারতের মোদির সরকারের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়। উদ্দেশ্য, রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সামরিক সহায়তার সম্পর্কে ভাগ বসানো। ভারতের সঙ্গে চীনের সাম্প্রতিক বৈরিতাকে কাজে লাগিয়ে ট্রাম্প সেখানে মার্কিন স্বার্থের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন। গত মার্কিন নির্বাচনে মোদি প্রকাশ্যে ট্রাম্পের জন্য ভোট প্রার্থনা করেছিলেন। কিছুটা হলেও জো বাইডেনের সঙ্গে ভারতের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। তারপরও অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে প্রতিযোগিতা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা চীনের সঙ্গে শুরু হয়েছে তার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছে। চীন চিন্তার সক্ষমতায় এখন ক্ষেত্রবিশেষে মার্কিনিদের ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশন। টেকনোলজির দিক থেকে চীন অনেক বেশি অগ্রসরমান। এমনি একটি অবস্থায় মার্কিন পলিটিশিয়ানরা চীনের উত্থান মেনে নিতে পারছে না। সে কারণে মার্কিন প্রশাসনের সর্বস্তরে চীন বিরোধী আবহ তৈরি হয়েছে। তারই অনুসরণে পৃথিবীর নানা দেশে নানা বৈদেশিক নীতি সৃষ্টি হচ্ছে।

পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করে বর্তমান সরকারকে বড় ধরনের রাজনৈতিক সাফল্য আনতে সহায়তা করেছে চীন। ’৭৫-পরবর্তী সরকার বাংলাদেশে তাইওয়ানের ট্রেড সেন্টার খোলার অনুমতি দিয়ে চীনের সঙ্গে স্থায়ী একটা বৈরিতার পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। তাইওয়ান প্রশ্নটি চীনের জন্য স্পর্শকাতর। যে মার্কিনিরা আজ তাইওয়ানের পক্ষ নিয়ে এত কথা বলে, তারাই ১৯৭২ সালে তাইওয়ানের জাতিসংঘের সদস্য পদ বাতিল করে চীনকে অন্তর্ভুক্ত করে। অথচ আমাদের দেশের তৎকালীন সরকার কোন যুক্তিতে বা প্রেক্ষিতে তাইওয়ানের ট্রেড সেন্টার করার অনুমতি দিয়েছিল তা বোধগম্য নয়। আজ বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের গভীর অর্থনৈতিক সম্পর্ক থাকার ফলেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রোষানলে পড়েছে এ কথা বলা যেতে পারে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানবতার লঙ্ঘনের যে অভিযোগ তুলেছে তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই বেশি যায়। মধ্যপ্রাচ্য, ইসরায়েল, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইরাক, মিসর, লিবিয়া এবং আফগানিস্তানের যুদ্ধ এবং যুদ্ধপরিস্থির দায় মার্কিনিরা এড়াতে পারে না। তারা কখনই এসব ‘অনৈতিক যুদ্ধের’ জন্য বিশ^বাসীর কাছে কোনো কৈফিয়ত দেয়নি। রবং আজ তারাই বিশ্বের নানা প্রান্তে মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র খুঁজে বেড়ায়, যা প্রতারণার শামিল।

মার্কিনিদের বিরুদ্ধে কোনো অবরোধ সৃষ্টি করা যায় না। কারণ, মার্কিন মুদ্রা ডলার বিশ্ব বাণিজ্যের চালকের আসনে দখল করেছে অনেক আগেই। যে কারণে তারা তাদের ইচ্ছামতো যে কোনো দেশের প্রতি বিভিন্ন ধরনের অবরোধ, নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে। বাংলাদেশের একটি বিশেষ বাহিনী, তার সদস্য কিংবা সংস্থার সাবেক প্রধানের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা তারা গ্রহণ করেছে সেটাও এর বাইরে নয়। যদিও অন্য অনেক দেশের মতো আমাদের দেশেও দীর্ঘদিন যাবৎ ‘বন্দুকযুদ্ধের’ গল্প প্রচলিত আছে। বন্দুকযুদ্ধ দিয়ে পৃথিবীর নানা দেশের নানা ইতিহাস রচিত আছে। কোনো কোনো দেশে বন্দুকযুদ্ধ সমস্যার একটি আপত সমাধান হয়তো দিয়েছে, কিন্তু এর মধ্য দিয়ে আরও হাজারটা সমস্যার জন্ম দিয়েছে। থাইল্যান্ড, ভারত, ফিলিপিন, কলাম্বিয়া, ব্রাজিলসহ পৃথিবীর বহু দেশে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ সংঘটিত হয়েছে। প্রচলিত আইনের দুর্বলতা, আইন প্রয়োগের শৈথিল্য, আইন প্রয়োগের অদক্ষতা এবং বিচারের দীর্ঘসূত্রতার ফলে জনমনে বন্দুকযুদ্ধের প্রতি এক ধরনের সমর্থন তৈরি হয়। মানুষ অত্যাচারী ও সন্ত্রাস সৃষ্টিকারীর বিনাশ দেখতে চায়, ‘বন্দুকযুদ্ধ’ কখনো কখনো মানুষের সেই ইচ্ছাপূরণের পরিপূরক হয়ে ওঠে। এই প্রবণতা বিপজ্জনক। এটা সভ্যতা ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন। এ ক্ষেত্রে দেশের প্রচলিত আইনের কোনো দুর্বলতা, আইন প্রয়োগের কোনো সীমাবদ্ধতা বা বিচারে যে কোনো ধরনের দীর্ঘসূত্রতা প্রতিরোধ করা গেলে আইনের প্রতি মানুষের আস্থা তৈরি হবে এবং বন্দুকযুদ্ধের প্রতি নির্ভরতা দূর হবে।

আমাদের অর্থনৈতিক সাফল্যের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যের বিরাট অংশ এই দুটি বলয়ের ওপর নির্ভরশীল। এটা সম্ভবত চীন-মার্কিন বাণিজ্য দ্বন্দ্বের একটি ফসল। তারপরও আমাদের পুরো বিষয়টাকে খুব গভীর মনোযোগের সঙ্গে দেখতে হবে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব খেয়াল রাখতে হবে। আমাদের দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা পুরোপুরি অর্জন করতে পারেনি। পত্রিকায় প্রকাশিত সাম্প্রতিক তথ্যচিত্রে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চাল আমদানিকারক দেশ! এই ভয়াবহ পরিস্থিতি মাথায় রেখে আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যে অটুট রাখার স্বার্থেই যেন আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতি প্রতিফলিত হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখা অত্যন্ত জরুরি।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক, কলামিস্ট

ভয়েস/আআ/সূত্র:দেশ রূপান্তর

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION